সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১৫ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম: জাতীয় সংসদে প্রায় ৫৫ ঘণ্টা আলোচনার পর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট পাস হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাজেট পাসের জন্য অর্থমন্ত্রী সংসদে এটি উপস্থাপন করেন। পরে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা এ সময় টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রীকে সমর্থন ও স্বাগত জানান। এর আগে, সকাল ১০টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বেব সংসদের বৈঠক শুরু হয়। শুক্রবার ১ জুলাই থেকে নতুন এ বাজেট কার্যকর হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের এটি টানা নবম বাজেট। এর আগে তিনি আরো দুটি বাজেট দিয়েছিলেন।
বাজেটের ওপর আলোচনায় বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা ৫৯টি ছাটাই প্রস্তাব এবং ৩২৫টি দাবি উত্থাপন করেন। এর মধ্যে আলোচনার জন্য সাতটি দাবি গৃহীত হয়। নতুন ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য সংযুক্ত তহবিল থেকে পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ২১৪ কোটি ১৫ লাখ ৯২ হাজার টাকার নির্দিষ্টকরণ বিল পাস করা হয়। বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা এসব দাবিতে আলোচনা করেন। পাস হওয়া বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এনবিআরের টার্গেট ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। এছাড়া এনবিআর-বহির্ভূত খাত থেকে কর রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। করবহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা।
বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি বাজেটে জিডিপির লক্ষ্য ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশন ইতোমধ্যে আভাস দিয়েছে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে। আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, যা বিগত চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে জানান অর্থমন্ত্রী। এছাড়া বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ ৫ দশিমক ৫ শতাংশে ধরে রাখার ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী।
নতুন এই বাজেটে অনুন্নয়নমূলক ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। তবে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর অর্থায়নে আরো ১০ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। সে হিসেবে মোট এডিপির আকার ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে; যা জিডিপির ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এই বাজেটে সার্বিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। এ ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক উৎস থেকে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা জোগান দেয়া হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি, সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে ৩২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা সংস্থানের ব্যবস্থা রেখেছেন অর্থমন্ত্রী।
নির্দিষ্টকরণ বিল পাস: আগামী অর্থবছরের বাজেট ব্যয়ের বাইরে সরকারের বিভিন্ন ধরনের সংযুক্ত দায় মিলিয়ে সংযুক্ত তহবিল থেকে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২১৪ কোটি ১৫ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার নির্দিষ্টকরণ বিল কণ্ঠভোটে পাস করা হয়।
মঞ্জুরি দাবি ও ছাঁটাই প্রস্তাব: আগামী অর্থবছরের বাজেটের ওপর সংসদে উত্থাপিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ খাতের ৩২৫টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা ৫৯টি ছাঁটাই প্রস্তাব আনেন। এর মধ্যে ৭টি দাবি আলোচনার জন্য গৃহীত হয় এবং বাকি ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। বাজেট পাস হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্পিকারের অনুমতি নিয়ে দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্যদের সবাইকে বাজেটোত্তর নৈশভোজে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান।
খাতওয়ারি বরাদ্দ: সংযুক্ত বিল ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২১৪ কোটি ১৫ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয় অর্থ বিভাগে। এ বিভাগের ব্যয় ২ লাখ ৬ হাজার ৫৩০ কোটি ৮৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। ব্যয়ের দিক থেকে সবচেয়ে কম হচ্ছে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে। এ খাতে ব্যয় ২১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
অনুমোদিত ব্যয় পর্যায়ক্রমে হচ্ছে প্রতিরক্ষায় ২৫ হাজার ৭৪০ কোটি ৭৫ লাখ ৮ হাজার টাকা এবং স্থানীয় সরকার বিভাগে ২৪ হাজার ৬৭৪ কোটি ১১ লাখ টাকা। অন্য খাতের ব্যয়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ খাতে ৩১৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় খাতে ১ হাজার ৪৫৭ কোটি ৬৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ৯৫ কোটি ৫ লাখ টাকা, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে ১ হাজার ৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার ৪৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা, সরকারি কর্মকমিশন খাতে ৭৪ কোটি ২২ লাখ টাকা। অর্থ বিভাগ মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কার্যালয় খাতে ১৯৬ কোটি ৫ লাখ টাকা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে ২ হাজার ২০৬ কোটি ৩ লাখ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ২ হাজার ৫৪০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ খাতে ১০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।
পাশাপাশি পরিকল্পনা বিভাগে ১ হাজার ৩৩২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে ১০০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে ৫১৮ কোটি ৭ লাখ টাকা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ৬১১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ১৮৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে ৩০ কোটি ৪১ লাখ টাকা, আইন ও বিচার বিভাগ ১ হাজার ৪২৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ১৮ হাজার ২৮৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগে ২১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২২ হাজার ২৩ কোটি ২৮ লাখ ১৯ হাজার টাকা, মাদমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে ২৩ হাজার ১৪৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় খাতে ১১ হাজার ৩৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য সেবা খাতে ১৬ হাজার ২০৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ৩ হাজার ৯৭৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ৪ হাজার ৮৩৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার ৫৭৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় খাতে ২৬২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় খাতে ৩ হাজার ৭৩৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, তথ্য মন্ত্রণালয় খাতে ১ হাজার ১৪৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪১৭ কোটি ৭৭ হাজার টাকা।
ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬৫৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় খাতে ১ হাজার ৩৮৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগে ১ হাজার ৮৮৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা, শিল্প মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ৮২৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে ৮৯৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে ২ হাজার ২২৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ে ১৩ হাজার ৬০৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় খাতে ১ হাজার ৯২৯ কোটি ৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় খাতে ১ হাজার ১২০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, ভূমি মন্ত্রণালয় খাতে ১ হাজার ৮৫৮ কোটি ৫৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৫ হাজার ৯২৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, খাদ্য মন্ত্রণালয়ে ১৪ হাজার ৪০২ কোটি ৯ লাখ ৮১ হাজার টাকা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৮ হাজার ৮৫৩ কোটি ১২ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।
এছাড়া সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ১৯ হাজার ৬৯৭ কোটি ২১ লাখ টাকা, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ১৬ হাজার ১৩৫ কোটি ৯ লাখ টাকা, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ৬৮৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার ৫২২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ১৫০ কোটি ১৮ লাখ ৬১ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিভাগে ১৮ হাজার ৮৯৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা, সুপ্রীম কোর্টের জন্য ১৬৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩ হাজার ৯৮৬ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জন্য ৬৮৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, দুর্নীতি দমন কমিশন খাতে ১০১ কোটি ৭১ লাখ টাকা, সেতু বিভাগে ৮ হাজার ৪২৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে ৫ হাজার ২৭০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, সুরক্ষা সেবা খাত ২ হাজার ৮৮২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ খাতে বরাদ্দ ৪ হাজার ৪৭৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। সংসদ অধিবেশন ৯ জুলাই পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করা হয়েছে।